প্রতিনিধি ৫ আগস্ট ২০২৫ , ৩:১৬:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ
মহসিন শামিম:
জুলাই আন্দোলনের ছবি নিয়ে বই ‘উইটনেস টু দ্যা আপরাইসিং’ এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ০৫ আগস্ট, সন্ধ্যায় অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) ও নেত্র নিউজের যৌথ উদ্যোগে করা হয় এই আয়োজন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোতে গুলি করে মানুষকে দমানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে গুলি করে মানুষকে দমানো যায় না, ইতিহাসেই তার প্রমাণ রয়েছে। জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড কে, তা নিয়ে নানাজন নানা রকম দাবি করেন। প্রকৃতপক্ষে জুলাইয়ের আসল মাস্টারমাইন্ড তারাই, যারা সে সময় রাস্তায় ছিল।
বইটিতে আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক জীবন আহমেদের চোখে দেখা জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতিটি দিনের ছবিসংবলিত বর্ণনা উঠে এসেছে। এতে আলোকচিত্রীর তোলা শহীদ নাফিসের রিকশায় ঝুলে থাকা ছবি অন্যতম। বইয়ে আন্দোলনের প্রতিটি ধাপ বিক্ষোভ, নির্যাতন, রক্ত, প্রতিরোধ, বিজয় ও বেদনার স্মারকচিহ্ন তুলে আনা হয়েছে।
এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবীর। তিনি বলেন, এই বই শুধু ছবি নয়, একটি সময়ের যন্ত্রণার প্রামাণ্য দলিল। এখানে আছে রাজপথে গড়ে ওঠা প্রত্যয়, আছে হারানোর বেদনা, আর আছে প্রতিরোধের গৌরব। এই কাজ সাহসিকতা এবং মানবতার এক অনন্য নিদর্শন।
লেখক সম্পর্কে খুশী কবির বলেন, জীবন আহমেদ ভয়ভীতি না করে ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কর্মজীবনের হুমকি, কাজের অনিশ্চয়তাসহ নানা বিপত্তি থাকলেও তিনি দমে যাননি। জীবনের মতো মানুষ থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে।
তিনি বলেন, একাত্তরের সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের তুলনা চলে না। একাত্তরে ধর্ম ও জাতি দুটোই শেষ করার লক্ষ্য ছিল। জুলাইয়ে শাসকেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, তারা ইতিহাসও ভুলে যায়। গুলি করে মানুষকে দমানো যায় না। একাত্তরের ২৫ মার্চ গুলি করার পরেই মানুষ জেগে উঠেছিল। জুলাইয়ে শাসকেরা নিজের দেশের মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ বলেন, প্রত্যেক ফটোগ্রাফারের একটা স্বপ্ন থাকে, তার একটা ছবির বই হবে। আমার সেই স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস। জুলাই এখনো চলমান। জুলাইয়ে কী ঘটেছে, সেটা ছবিসহ আমি বইয়ে তুলে ধরতে চেয়েছি।
জুলাইয়ের মাস্টারমাইন্ড সম্পর্কে জীবন আহমেদ বলেন, আসলে জুলাইয়ের কোনো মাস্টারমাইন্ড নাই। রাস্তায় যারা ছিল, তারাই মাস্টারমাইন্ড।
শহীদ নাফিজের বাবা গোলাম রহমান তার ছেলের সঙ্গে শেষ কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘নাফিজ বলেছিল, ‘‘আব্বু তুমি যদি অনুমতি দাও, আমি বন্ধুদের নিয়ে শাহবাগের দিকে যাব।’’ যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘‘আব্বু ভাংতি টাকা আছে?’’ আমার পকেটে তখন ১৩০ টাকা। সে কেবল ৩০ টাকা নিয়েছিল। সেটা নিয়ে মাথার পতাকা কিনেছিল। বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিল নাফিজ। এরপর জীবন আহমেদ পত্রিকায় যে ছবিটা দেয়, ওটা দেখে আমি নিশ্চিত হই, আমার ছেলে আর নাই।’ গত ০৪ আগস্ট ২৪ শহীদ হয় নাফিজ। তার কপালে তখনো সেই পতাকা বাঁধা ছিল।
নাফিজকে বহনকারী রিকশাচালক নূর মিয়া বলেন, আমি ছেলেটার নাম জানি না, পরিচয়ও জানি না। ওই মুহূর্তে কী পরিমাণ গুলি চলছিল, কেউ তখন আগায় আসে নাই। উনি (জীবন আহমেদ) জীবনের মায়া ত্যাগ করে ছবি তুলছেন।
নাফিজের কপালে বাঁধা পতাকার কথা উল্লেখ করে নূর মিয়া বলেন, এই পতাকার সম্মান সবাই দিতে পারে না। আমার দেশের পতাকা থাকবেই। আমরা পিস্তল নিয়া গুলি নিয়া খেলতে রাজি না। র্যাব ছিল, পুলিশ ছিল, একটা প্রাণী আসে নাই ছেলেটাকে ধরতে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নেত্র নিউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইখতিশাদ আহমেদ। আলোচনায় অংশ নেন নেত্র নিউজের এডিটর ইন চিফ তাসনিম খলিল, ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন প্রমুখ।
আলোচকেরা বলেন, জুলাই আন্দোলনে জীবন আহমেদের ভূমিকা কেবল সাংবাদিক-আলোকচিত্রী হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের আস্ফালন উপেক্ষা করে সত্যকে তুলে আনার প্রতিজ্ঞায় নিজের জীবন বাজি রেখেছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, দিনের পর দিন ঘরছাড়া-ছন্নছাড়া জীবনযাপন করেছেন। তিনি আন্দোলনের সঙ্গে পুরোপুরি একাত্ম এক অংশীজন হয়ে উঠেছেন।
সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার অঙ্গীকার তাকে অভ্যুত্থানের পরেও পথেই থাকতে বাধ্য করেছে। অভ্যুত্থানের দিনগুলোর মতোই তার ক্যামেরায় ধরা আছে অভ্যুত্থানপরবর্তী পটপ্রবাহ, আহত ব্যক্তিদের সংগ্রাম, নিহত ব্যক্তির পরিবারের যন্ত্রণা।