নিজস্ব প্রতিবেদক:
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের উদ্যোগে ‘জনপ্রশাসন সংস্কারঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক একটি সেমিনার আজ রাজধানীর রমনাস্থ ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) এর সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিরা এসময় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বিষয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশে ইতোপূর্বে আরও ২৬টি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন/কমিটি গঠিত হয়েছিলো। অন্য সব কমিশন হতে এবারের কমিশন ভিন্ন হবে- এমনটি প্রত্যাশা ছিল জনগণ ও কর্মচারীদের। পূর্বের কমিশনগুলোর ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করে, সে ভুল পুনরায় না করতে সরকারকে আগেই লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলো আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। কিন্তু এবারও পূর্বের ন্যায় পক্ষপাতদুষ্ট কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রত্যাশিত জন-আকাঙ্খা পূরণে কাঙ্খিত সিভিল সার্ভিস গঠনে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে দেশ। ‘জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন গড়িয়া তুলিবার লক্ষ্যে’ কমিশন গঠিত হলেও, এ কমিশন অতীতের ন্যায় কাগুজে জনমুখী হতে যাচ্ছে বলে পরিষদ মনে করে।
জনাব রহমান আরও বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে ২৫টি ক্যাডারের পক্ষ থেকেই পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং উপসচিব পদে কোটা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছিলো। সমাজের বিভিন্ন স্তর হতেও সিভিল সার্ভিসে পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দেবার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। অথচ, জনদাবিকে উপেক্ষা করে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে একটি গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধির প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। এই রিপোর্ট পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এবং প্রশাসনিক ফ্যাসিজম আরও শক্তিশালী হবে। আর সিভিল সার্ভিসের কার্যকর সংস্কার ছাড়া অন্য সকল সংস্কার অকার্যকর হয়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ সময় বলা হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার প্রতিবেদনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, পরিসংখ্যান, ডাক, অডিট এন্ড একাউন্টস প্রভৃতি ক্যাডার বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও জেলা পরিষদকে বিলুপ্তির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বকে উপেক্ষা করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বাস্তবতা বিবর্জিত প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায়। আন্ত: ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া কোন সংস্কার গ্রহণযোগ্য হবে না বলে তারা জানান।
সভায় পরিষদের পক্ষ থেকে কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় (ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার) বাস্তবায়ন, উপসচিব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, সকল ক্যাডারের সমতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ সব ক্যাডারকে একই কমিশনের আওতায় রাখা, পরিবার পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান ক্যাডারকে সার্ভিসে অব্যাহত রাখা, সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে প্রবেশের পর শুধুমাত্র প্রশাসন ক্যাডারের জন্য পূর্বের সার্ভিসে ফেরার সুবিধার প্রস্তাব বাতিল, জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব বাতিল, ‘এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ এর পরিবর্তে ‘ভূমি সার্ভিস’ বা ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা সার্ভিস’ নামকরণ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ‘মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়’ অথবা ‘সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়’ হিসেবে নামকরণসহ বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট এম. এ. আজিজ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক আহমেদ ইকবাল চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট ফিরোজ আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু, প্রানিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাক্তন পরিচালক ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব (শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক) ফয়সাল মাহমুদ শান্ত ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার খান মঞ্জুর মোরশেদ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, কার্যকর জনসেবা নিশ্চিত করতে হলে, কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতেই হবে অর্থাৎ প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে স্ব-স্ব ক্যাডারের/ সেক্টরের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তারা পদায়িত হবেন। তাঁরা আরও বলেন, সকল সেক্টরে একটি ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় সার্ভিসে পেশাদারিত্ব মারাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে এবং সৃষ্ট আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অব্যবস্থাপনার ফলে সেক্টরগুলো কাঙ্ক্ষিত জনসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না।
সেমিনারে আরও বলা হয়, বৈষম্যহীন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তার দ্বারা পরিচালনা এবং কোটামুক্ত মেধাভিত্তিক উপসচিব পুল অত্যন্ত জরুরি বলে বক্তারা মত দেন। তাছাড়া কোটা পদ্ধতি জুলাই বিপ্লবের সাথে সাংঘার্ষিক বলে সেমিনারে উল্লেখ করা হয়। সেমিনারে আরও বলা হয় যে, ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ নিজেদের সেক্টরের প্রতি নজর না দিয়ে অন্য সকল সেক্টরের শীর্ষপদ দখল করে অকার্যকর প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন।
বক্তারা বলেন, বিরাজমান প্রশাসনিক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ২৫টি ক্যাডারের প্রায় সকল শীর্ষ পদে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রদায়ন নেই। এতে, সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তারা কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলছেন। ফলে জনগণ তাঁদের কাঙ্খিত সেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁরা বলেন, দক্ষ, পেশাদার ও গতিশীল সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যথাসময়ে পদোন্নতিসহ সকল ক্যাডারের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। একই দেশে একটি ক্যাডারের কর্মকর্তা পদ না থাকা সত্ত্বেও প্রমোশন পাবে, আর অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদ থাকা সত্ত্বেও প্রমোশন পাবে না - এটা কোন সভ্য প্রশাসন ব্যবস্থা হতে পারে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় এটা প্রশাসন ক্যাডারের ইচ্ছাকৃত সৃষ্ট জটিলতা ও উপনিবেশিক মনোভাব বলে মনে করেন বক্তারা। সেজন্য এ অনিয়ম দূর করতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ও সেমিনার আয়োজন কমিটির আহবায়ক মোঃ জামিলুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ।